গোবর ঢেলে উঠানটা নিকিয়ে দিয়েছে পূর্ণিমা। মনের ভেতর প্রশান্তির ঢেকুর তোলে, ঘরদোর পবিত্র হয়েছে ভেবে। কলসি নিয়ে পুকুরঘাটে চলে যায়। কলসিটা এক পাশে রেখে পা দুটো জলে ডুবিয়ে দিয়ে ঘাটে বসে পড়ে পূর্ণিমা। মনের অজান্তে সে পা দুটো জলে ডুবিয়ে রেখে দোলায় আর সে দুলুনিতে ছোটো ছোটো ঢেউ ওঠে। তাতে ভেতরে উষ্ণ উষ্ণ খুশি দোল খায়। আচমকা চোখের দৃষ্টি একটু সরাতেই চোখ দুটো আটকে যায়। পুকুরের মাঝখানে দুটো হাঁস পাখনা মেলে পরস্পর আদর বিনিময় করছে। পূর্ণিমার মনের ভেতরে একটু উষ্ণ আবেগ এসে জড়িয়ে ধরে। পলকহীন চোখে হংস-হংসীর প্রেমলীলা দর্শন করে বেশ কিছুক্ষণ। এ সময় পেছন থেকে তার চোখ চেপে ধরে কেউ। পূর্ণিমা হাত দিয়ে পেছন দিকে ছুঁয়ে বলে, ‘কাঞ্চা।’
চোখ ছেড়ে দিয়ে কাঞ্চা বলে, ‘এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছিলি রে?’
‘রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা দেখছিলাম।’
‘পূর্ণিমা, এইসব কী বলিস রে! তুই কোনো কৃষ্ণের সন্ধান পাইছিস নাকি?’
পূর্ণিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেয়, ‘বাস্তবে কৃষ্ণকে না পাইলেও আমার মন-হৃদয়-শরীরের সব জায়গায় কৃষ্ণ খেলা করে। চর্মচোখ দিয়া দেখি না কিন্তু মনের চোখ দিয়া দেখি।’
‘পূর্ণিমা, তুই তো গোঁসাই, মানে আমাগো গুরুদেবের মতো কথা বলিস।’
‘গুরুদেবের দীক্ষা নিয়েছি। তাইলে আমি আর আলাদা কী। তার রূপ ভক্তের কামনায় বিরাজমান- যে যোগী সকলের মধ্যে আমারে এবং আমার মধ্যে সকলরে দেখেন, আমি কখনো তাহারে হারাই না, তিনি কখনো আমারে হারান না।’
‘বাহ্! দারুণ! পূর্ণিমা, তুই তো সত্যি সত্যি গোঁসাইর নিকট নিজেকে বিলীন করতে পারছিস। এইজন্য গুরুদেব আইলে অন্য কোনো ভক্তের ঘরে ওঠে না। শুধু তোর ঘরে থাকে। গুরুদেব নাকি আইবো?’
‘হুম! আগামী মঙ্গলবার আইবো!’
‘বুঝতে পারছি, এই কারণে তোর চোখ-মুখ-শরীর দিয়া খুশি উপচা পড়তাছে।’
পূর্ণিমা যেন ওর কথায় কিছুটা লজ্জা পায়। মুখটা আলতো ঘু-রিয়ে নেয়। কিশোরীর মতো লাজুক হাসি হাসে।
পূর্ণিমার ছোট্ট কুঁড়েঘর। চারপাশে মাটির দেওয়াল। ঘরের এক কোণে গুরুদেবের ছবি। ওর পরনে বৈধব্য বসন। গলায় তুলসীর মালা। ভেজা চুলগুলো এলিয়ে দিল। টপটপ জল পড়ছে চুল থেকে। গুরুদেবের ছবিতে ফুল দিয়ে তাকিয়ে আছে । ভেতরটা যেন কেমন করে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বিনীতভাবে ভক্তি করে পেছন ফিরে তাকাতেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়! এটা কী স্বপ্ন! তার পুরো চেহারাটা লাবণ্যে ভরে উঠল। ত্রিশোর্ধ্ব বিধবার জীবনে আর কিছু না থাকলেও ভগবান কৃষ্ণের লীলায় নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখে সর্বক্ষণ।
সে দৌড়ে পূর্ণজলের ঘড়া দিয়ে গুরুদেবের পা ধুয়ে নিজের শুভ্র আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিতেই বুকের বসন কিছুটা সরে যায়। আর গুরুদেবের তির্যক চোখ পড়ে সেদিকে। সদ্য স্নান সেরে এসেছে। শাড়ির নিচে ব্লাউজ নেই। নিয়মমাফিক পূর্ণিমা স্নান সেরে গোঁসাইর ছবিতে পুজো দেওয়ার পর ব্লাউজ পরে নেয়। কারণ ও জেনেছে মনের বান্ধবের সামনে আবরণ দিয়ে ঢাকা ভন্ডামী। ভগবানরূপী গুরুদেবের সামনে নিজেকে প্রকৃতরুপে উপস্থাপন করতে পারলেই ভগবান খুশি হন। পোশাকটা একটা খোলস মাত্র। আদি মানব লুক্কায়িত খোলসটার ভেতরে। তাই তো ভগবানের সামনে এসব খোলসের আবরণ থাকলে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হতে পারেন না। মেঝেতে পাটি পেতে গোঁসাইকে বসতে দেয় পূর্ণিমা। গুরুদেব যোগাসনে বসে। পূর্ণিমা পাশে বসে পাখায় হাতে বাতাস দিতে দিতে জানতে চায়, ‘গুরুদেব আপনার তো আগামী মঙ্গলবার আইবার কথা। কিন্তু আইজ হঠাৎ…?’
‘পূর্ণিমা, জানি না। আজ কেন এলাম তোমার টানে। তুমি খুশি হও নাই?’
‘আপনি ভালো কইরাই জানেন যে, আমার মনের অবস্থা এখন কেমন হতে পারে।’
‘পূর্ণিমা, জানি এবং আগে থেকেই জানতাম তোমার মন ব্যাকুল! দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকার কারণে আমার প্রিয় বান্ধবের মনের খবর পাইছি।’
গোঁসাই গুনগুন করে গেয়ে ওঠে-
‘আমি ঘুরে দেখলাম সারা জগৎ
তোর মতো বান্ধব না পাই।’
গোঁসাইয়ের কণ্ঠে ভাবের গান শুনে পূর্ণিমা লজ্জায় বাঁকা চোখে তাকায়। তার ভেতরে যেন রসিকজনের জন্য একটা ভালো লাগা আনন্দ লঘু টেউয়ের মতো দোল খাচ্ছে।
পাঁচ বছর হয় পূর্ণিমার স্বামী গদাই মাঝি সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফেরত আসেনি। এর পর থেকে মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনোরকমে দিন চলছিল তার। উপকূলীয় এলাকায় সকলের পেশা মাছ ধরা। গদাই মাঝির মতো আরো অনেকেই সাগরে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।
পূর্ণিমার স্বামী বেঁচে থাকাকালীন গোঁসাই এ পাড়ায় আসত। আগে এই গোঁসাইয়ের বাবা আসত। তার কাছে সবাই দীক্ষা নিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে পুত্র গোঁসাইয়ের সিদ্ধি লাভ করে। সে সূত্র ধরেই ছোটো গোঁসাই মাঝে মাঝে এখানে এসে কয়েক দিন থেকে পূজা-অর্চনা করে চলে যায়। বিনিময়ে দরিদ্র জেলেরা সামর্থ্য অনুযায়ী গোঁসাইকে খুশি করতে কৃপণতা করে না।
পূর্ণিমার শরীরে বৈধব্যের সাজ ওঠার পর থেকেই গোঁসাইয়ের কাছে দীক্ষা নিয়েছে। সেই থেকে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে গুরুদেবের চরণে। এ পাড়ায় গুরুদেবের প্রিয় বান্ধব পূর্ণিমা। আধ্যাত্মিক জগতের ভাষায় বান্ধব মানে ঈশ্বরের অতি প্রিয় ভক্ত। কারণ তার সব ভক্তের কাছে গোঁসাই ভগবানের প্রতীকরূপী ।
গোঁসাইয়ের জন্য জলখাবার তৈরি করে কলাপাতায় খেতে দেয় পূর্ণিমা। গোঁসাই কখনো থালায় খাবার খায় না। বেগুন ভাজা, সবজি, ডাল দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে গোঁসাই। আর পূর্ণিমা নিজ হাতে তৈরি পাখা দিয়ে বাতাস করছে। মাটির ঘটি থেকে জল খেয়ে পূর্ণিমার দিকে তাকায় সে। তাকানোটা কেমন যেন রহস্যময় লাগে পূর্ণিমার কাছে। খাওয়া শেষ করে কলকিতে দীর্ঘ একটা টান দেয় গুরুদেব। গাঁজা দিয়ে আগে থেকেই কলকি সাজিয়ে রেখেছে পূর্ণিমা। কলকিটা নিচে রেখে গোঁসাই বলে, ‘বাহ্! বেশ সেঁধেছ তো বান্ধব।’
পূর্ণিমা কোনো উত্তর না দিয়ে আলতো হাসে।
‘বান্ধব, তুমি তো এখন সব শিখে গেছ। ভালো গান গাইতে পারো। তুমি এখন সব ধাপ পার করেছ। বাকি আছে আর একটা ধাপ। এইটা যদি পার করতে পারো তবেই তুমি বৈষ্ণবী হিসেবে সিদ্ধি লাভ করতে পারবে। এর জন্য তোমাকে বৃন্দাবন যাইতে হবে।’
‘গুরুদেব, আপনার কাছে জীবন-মন-দেহ সব সমর্পণ করেছি। যা-ই বলবেন তা-ই করতে অইবো।’
‘বান্ধব তোমাকে নেওয়ার জন্য আসছি। তুমি দুই দিনের মধ্যে সব গোছগাছ কইরা নিবা।’
ভরা পূর্ণিমাতলে ভক্তকুল জমায়েত হয়েছে। মধ্যখানে গোঁসাই আসন গেড়ে বসেছে। পরনে লাল থান, গলায় কাঠের গোটা দিয়ে তৈরী মালা। হাতে একতারা। উপস্থিত ভক্তকুল একে একে গুরুদেবের পায়ে ভক্তি দিয়ে কপালে লম্বা করে সিঁদুর পরে নেয়।
পূর্ণিমা গুরুদেবের পায়ে ভক্তি দেয়। ভক্তি দিয়ে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে গোঁসাই নিজের কপাল থেকে চন্দন নিয়ে পূর্ণিমার কপালে পরিয়ে একতারাটা ওর হাতে দেয়।
পূর্ণিমা একতারা হাতে উঠে দাঁড়ায়। মাথার কালো চুলগুলো খোলা। পিঠ বেয়ে নিচে নেমেছে। গলায় বড়ো বড়ো কাঠের মালা। পূর্ণিমা গলা ছেড়ে গান ধরে-
‘কর গুরুতত্ত্ব সার
ওরে মন আমার
গুরু বিনে কেউ
হতে পারবা না পার।
ও মন যাইবা যদি ভবপারে
ঘাট যাইয়া গুরুর দ্বারে।
গুরু তোরে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে
কখন ফেলে যাবে না আর।’
চরম জমে উঠেছে আসর। মধ্যরাতে ভক্তগণ আলোকের মদিরতায় কান্নায় ভেঙে পড়ে। কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সকলে যার যার কাজে নেমে পড়ে। পূর্ণিমা সদ্য ভোরে স্নান সেরে গুরুদেবের পায়ে ভক্তি দেয়। গুরুদেবও স্নান করবে। ভাং মেলানো সরষের তেল একটা বাটিতে। আর একটা মাটির প্রদীপ জ্বেলে গুরুদেবের সামনে রাখে। গোঁসাইর বয়স কত হবে তা বোঝা মুশকিল। যদিও চুল-দাড়ি এখনো কাঁচা। আসলে দাড়ি-গোঁফ বড়ো থাকায় বয়স আন্দাজ করা যায় না। তবে শরীরের গঠন বেশ পোক্ত। মেদহীন মানানসই শরীর।
ঘরে দরজা বন্ধ। গোঁসাই শরীরের সব বসন খুলে এক পাশে রেখে দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। পূর্ণিমা অনেক যত্ন করে শরীর ম্যাসাজ করে তেল মালিশ করে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে প্রকৃতির নিয়মমাফিক গোঁসাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আর এটাই সত্যি। নর-নারীর সম্পর্ক প্রাকৃতিক। এটাই ধর্ম। এর ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় হয় না।
পরদিন বৈধব্যের শুভ্র বসন পরিবর্তন করে পূর্ণিমার গায়ে ওঠে গেরুয়া বসন। একতারা হাতে রাস্তায় নামে বৃন্দাবনের উদ্দেশে।

Make love. Young male and female hands on bed, closeup, empty space