সেলুলয়েডের ফিতায় বিমূর্ত গল্প আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে পর্দায় পড়ে যখন সচল হয়, তখন জীবন্ত সব জীবনের গন্ধ, ঘটনাপ্রবাহসহ নানা বিষয় সিনেমার মাধ্যমে মূর্ত রূপ ধারণ করে। সিনেমা মূলত জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। মানুষের হাতে আঁকা ছবি অতঃপর ক্যামেরার আবিস্কারের মাধ্যমে ধারণকৃত চিত্র পর্দায় প্রক্ষিপ্ত হয়ে চলচ্চিত্র আবিস্কার সম্পূর্ণতা পায় ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের লুমিয়ের ভাইদের হাতে। চলচ্চিত্র বিষয়টি খুব বেশি পুরোনো নয়। চলচ্চিত্রের পথযাত্রায় বিষয়, প্রয়োগ, আঙ্গিকে যোগ হয়ে কাহিনির চিত্রগ্রহণ, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, নান্দনিকতা, রং, শব্দ, বিভিন্ন ফরমেট যোগ হয়- চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে আধুনিক বিনোদন তথা যোগাযোগের মাধ্যম রূপে।
পূর্ববঙ্গে চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ১৯৩১ সালে নির্বাক ছবি ‘শেষ চুম্বন’-এর মাধ্যমে। বাংলা চলচ্চিত্রের অঙ্কুরপর্বে যে নামটি পেরেক ঠুকে গেঁথে আছে সে সিনেমাটি হলো ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে। পাকিস্তান পর্বেও চলচ্চিত্র ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের প্রধানতম বিনোদন মাধ্যম। দলবেঁধে পাড়া-মহল্লার মানুষের সিনেমা দেখার একটা চল ছিল। ভারতীয় বাংলা সিনেমার বাজার তখন তুঙ্গে। ‘সাগরিকা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘হারানো সুর’- এ রকম অনেক সিনেমায় বাজিমাত অবস্থা। হিন্দি, উর্দু ছবির বাজারও মন্দ ছিল না।
৫০-৬০ দশকের সিনেমাগুলোর বেশিরভাগ যেন মানুষের জীবনের কথাই বলে যেত। মানুষ তন্ময় হয়ে সিনেমা হলের ছারপোকার কামড় খেয়েও অপলক দৃষ্টিতে পর্দার দিকে উবু হয়ে তাকিয়ে থাকত। সিনেমার প্রতি ইন্দ্রজালিক মোহে আচ্ছন্ন ছিল বাঙালি।
দেশ স্বাধীন হলে সিনেমার কাহিনি, ঢং ও রং বদলায়। নব্য স্বাধীন দেশে ‘ওরা ১১ জন’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’ নামীয় ছবি বাঙালি জাতীয়তাবাদের নব বার্তা দিতে থাকে। সামাজিক ছবিও তৈরি হয় অনেক- ‘অবুঝ মন’, ‘ময়না মতি’ ইত্যাদি ছবি বেশ আলোড়ন তৈরি করে। দর্শক কমেনি বাংলাদেশ পর্বে বরং বাড়তে থাকে। জেলা শহরগুলোতে সিনেমা হলের ব্যবসাও রমরমা ছিল। এমনকি হল মালিকরা শহরের শুধু টাকাওয়ালা নন, সমঝদার লোক হিসেবেও সুনাম কুড়াতে থাকেন। ঢাকার বলাকা, গুলিস্তান, যশোরের মণিহার ছিল দেশখ্যাত প্রেক্ষাগৃহ। আমার জেলা শহর টাঙ্গাইলে ছিল ‘রূপসী’, ‘রওশন’, ‘কেয়া’, ‘রূপবাণী’ ও ‘মালঞ্চ’ নামীয় পাঁচটি প্রেক্ষাগৃহ। শহরের হলগুলোতে যথাক্রমে বপ, ডিসি, বিয়েলস্টল, স্টল নামীয় নানা দামের টিকিট বিক্রি হতো। স্কুল পালিয়ে দুই টাকা সম্বল করে সিনেমা হলের দারোয়ানের দ্বারস্থ হতাম। সিনেমা হলের দারোয়ান একদম পর্দার সামনে বসিয়ে দিত। মাথা উঁচু করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ২-২.৩০টা পর্দায় দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতাম। ঘাড় ব্যথা হয়ে যেত, কিন্তু মুগ্ধতার ঘোর কাটত না- এসব এখনও স্মৃতিতে সুখময়।\হ৮০-এর দশকে ‘রংবাজ,’ ‘ইয়ে করে বিয়ে’, ‘আলোর মিছিল’, ‘ডাকু মনসুর’, ‘মাল্কা বানু’, ‘লাঠিয়াল’, ‘সুজন সখী’, ‘শাপমুক্তি’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘সারেং বৌ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘বুলবুল-এ বাগদাদ’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘এতিম’, ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’, ‘আলিফ লায়লা’, ‘কসাই’সহ অনেক ছবি সুনামের সঙ্গে ব্যবসাসফলতা পেয়েছে।
তখন সামাজিক, পৌরাণিক ও ধর্মমূলক ভাগ-বিভাজনে সিনেমা তৈরি হতো। তখন বাংলা ছবির জোয়ার ছিল কারণ, সাধারণ দর্শক ছাড়াও খাঁটি শিল্পোত্তীর্ণ সিনেমার দর্শকও ছিল অনেক। সিনেমার জন্য অনেক দর্শক প্রয়োজন। দু-চারজন বোদ্ধার জন্য সিনেমা তৈরি করে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। চলচ্চিত্রের দর্শক হতে হবে স্টিভেন স্পিলবার্গের মতো। যে দর্শক বলবে, যতবারই আমি ছবি দেখতে সিনেমা হলে যাই, মনে হয় জাদু দেখছি। সব সিনেমাই আমাকে জাদুমন্ত্রের মতো মোহাবিষ্ট করে। সেটা যে ধরনের ছবিই হোক না কেন। এ বিষয়টি চলচ্চিত্রের বাণিজিক প্রসারে জরুরি। বাংলাদেশের সিনেমার বাজারে ধস নামে ‘৯০-এর দশকের প্রারম্ভে।
‘৯০-এর দশকে পাইরেসিতে বাজার সয়লাব হয়। পাশাপাশি হিন্দি ছবিও বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশে দর্শকপ্রিয়তা পায়। বাংলা সিনেমার সঙ্গিন দশা আরও বেশি নাকাল হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসির) অব্যবস্থাপনার জন্য। সিনেমার উন্নয়নে দেশ স্বাধীন হলে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠান সাতটি প্রধান লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে- (১) চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য শুটিং, ডাবিং, এডিটিং, রেকর্ডিং, প্রসেসিং, প্রিন্টিংয়ের জন্য কাঁচামাল ও কারিগরি সহায়তা দান, (২) বেসরকারি স্টুডিওগুলোতে সহায়তা দান, (৩) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভিজ্ঞ শিল্পী, কুশলী তৈরি ও নতুন প্রতিভার অনুসন্ধান, (৪) উন্নতমানের চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা, (৫) চলচ্চিত্র উৎসব, মেলা প্রদর্শনী ও সেমিনারে অংশগ্রহণ ও আয়োজন করা, (৬) বাজার সম্প্রসারণ, (৭) চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য অন্য যে কোনো দায়িত্ব পালন করা। পরিত্রাপের বিষয়, এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি একেবারেই অকার্যকর হয়ে পড়ে ৯০-এর দশকে। যে প্রতিষ্ঠানটি সিনেমার জগৎকে মনোহর করে তুলতে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল, সেই প্রতিষ্ঠানের ভঙ্গুর দশা দেশের সিনেমার জগৎকে প্রতিদিন বিবর্ণ করেছে।
‘৯০-এর দশকে ভার্চুয়াল বিনোদনের বিভিন্ন উপকরণ বাংলাদেশে সংযুক্ত হয়। ফলে সিনেমা হলের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমতে থাকে। বাংলা সিনেমার কাহিনি ও সংলাপ হয় নিম্নগামী। মানুষের জীবন থেকে অনেকটা দূরে সরে যায় সিনেমা। মানুষ সিনেমার মধ্যে জীবনের গল্পগুলোর অনুষঙ্গ খুঁজে পায় না। সিনেমার উৎপাদন কমতে থাকে এবং প্রেক্ষাগৃহগুলোর মালিকরা সার্বিক মুনাফার আশায় অন্য ব্যবসা শুরু করেন। বাংলা সিনেমা অনিশ্চিত গন্তব্যে এগোতে থাকে। বাংলা সিনেমায় অযাচিত মারপিট, রুচিহীন নৃত্য কিছু দর্শককে মনোরঞ্জন দিলেও সার্বিক বিচারে সিনেমার মান ও বাজার দুই নিম্নগামী হয়। সিনেমা হলগুলো দর্শক হারাতে থাকে। বাংলা সিনেমা হারায়, হারানো গৌরব।
চলচ্চিত্রের মান, রুচি, সংস্কৃতিতে গত তিন দশক ধরে চলছে অধগমন। জহির রায়হান, খান আতা ও এতেশামের মতো নির্মাতা জনরুচির সপক্ষে চলচ্চিত্রে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে সংযোগ ঘটেনি। চলচ্চিত্রের তারকা সংকটও প্রকট হয়। রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীর, উজ্জ্বল, বুলবুল আহমেদ, জাফর ইকবালের মতো নায়ক কিংবা শাবানা, ববিতা, কবরী, রোজিনা, অলিভিয়া, সুচরিতার মতো নিবেদিত শিল্পীও গত দশকগুলোতে চলচ্চিত্রের দুয়ারে খুব একটা দেখা মেলেনি। চলচ্চিত্র তার সোনালি অতীতকে স্মৃতির ঘরে স্থান করে দিতে থাকে এবং সিনেমার প্রধান দর্শক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত হলবিমুখ হয়।
একটা সময় ছিল বাংলা সিনেমার গান শুধু লোকমুখে মাঠে-ময়দানে উচ্চারিত হতো না- এ যেন ছিল অবসর বিনোদনের সাথি। অনেকেই মনের আনন্দেই চলচ্চিত্রের গান গুন গুনিয়ে গাইতেন। গানের সুর, তাল, লয়ে ছিল এক জাদুকরী আকর্ষণ।
এখনও তরুণ বয়সের স্মৃতি মন্থনে মনে হয় বাইসাইকেল চালাতে চালাতে উঠতি বয়সে গাইতাম বাংলা সিনেমার কলি-
… ধীরে ধীরে চল ঘোড়া, সাথী বড় আনকোরা (শাপমুক্তি, শিল্পী খুরশীদ আলম)
… সব সখীরে পার করিতে নেবো আনা আনা/ তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা [সুজন সখী]
… এক দিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাবো/ নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাবো [ছুটির ঘণ্টা]
আজকাল বাংলা সিনেমার গান মন-জুড়িয়ে মনে রাখার মতো সচরাচর হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্রে রুচি ও নতুন চিন্তার সংযোগ থাকলেও সেসব সিনেমার সংখ্যা কম এবং তাদের বাণিজ্যিক সফলতাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উৎসাহব্যঞ্জক নয়। বর্তমানে যেসব সিনেমা দর্শকদের নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করেছে, সে তারিকায় আছে- দারুচিনি দ্বীপ, ডুবসাঁতার, মাটির ময়না, রানওয়ে, ছোটকাকু, আয়নাবাজি, জীবনঢুলী, গেরিলা, মনপুরা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, শ্যামল ছায়াসহ বেশকিছু সিনেমা। উল্লিখিত সিনেমা সুনাম কুড়ালেও ব্যাপকভাবে দর্শকদের হলমুখী করতে পারেনি।
চলচ্চিত্রের জন্য সিনেমাবান্ধব সমাজ আমাদের নেই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অতিসম্প্রতি ‘চলচ্চিত্র’ শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে, এখন অতি স্বল্পসংখ্যক সিনেমা নির্মাণে স্বল্পসুদে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঋণ প্রদান করা হয়। কিন্তু দর্শক পর্যাপ্ত না থাকলে সিনেমা বানিয়ে কী লাভ?
একটা সময় ছিল বাংলা সিনেমা ঘিরে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এক ধরনের মাদকতা কাজ করত। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছবি, পোস্টার ঘরে মানুষ লাগিয়ে রাখত। এখন ভার্চুয়াল যুগে এসবের চল কম। সিনেমা নিয়ে অনেক পত্রপত্রিকা ছিল। চিত্রালী, পূর্বাণী, তারকালোকসহ বেশকিছু সিনেমাবিষয়ক পত্রিকা চলচ্চিত্রের নানা রকম খবর পরিবেশন করে সিনেমার মাঠ গরম করে রাখত- আজ এসব পত্রিকাগুলো হারিয়ে গেছে।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ, চলচ্চিত্র শিক্ষা ও ফিল্ম আর্কাইভ, এফডিসি সবই আছে। তবে এদের সক্ষমতা বাস্তবসম্মত নয়। তাই প্রতিদিন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা কমছে, প্রেক্ষাগৃহগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণে সব পক্ষের যৌথ আন্তরিক প্রয়াস প্রয়োজন। শিল্পের প্রতি দরদ ও নিষ্ঠার মিশেলে কার্যকর উদ্যোগ ভীষণ প্রয়োজন। কারণ চলচ্চিত্র শিল্পের বড়ই দুর্দিন। অথচ এই বাংলার সন্তান হীরালাল সেন অবিভক্ত বাংলা তথা সারা ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন করে এ উপমহাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে পৃথিকৃত্যে আসন অলঙ্কৃত করে আছেন।
সুস্থ সমাজঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র তরুণ-তরুণীসহ সব পেশা-শ্রেণির মানুষের মানসিক বিকাশে প্রয়োজনীয় একটা উপকরণ- এই বোধটি নিয়ে সংশ্নিষ্টদের চিন্তা ও কর্মযোগের এখনও সময় রয়েছে।
বাংলা সিনেমা এখন শুধুই স্মৃতি। ‘বুলবুল-এ বাগদাদ’ সিনেমার নায়ককে যখন শৈশবে সিনেমার পর্দায় উড়তে দেখেছিলাম, নিজে উড়তে চেয়েছিলাম, সেটা অধরাই রয়ে গেছে। পাশাপাশি এও মনে পড়ছে, ছোট বয়সে মা ‘ছুটির ঘণ্টা’ সিনেমা দেখে আমাকে ছড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন অঝোরে। এখন এমন সিনেমা নির্মাণ হয় না। তাহলে আমরা কি বাংলা সিনেমার সোনালি অতীতের স্মৃতির গল্প বলব, নাকি সবাই মিলে বাংলা সিনেমার সোনালি অতীতকে ফিরিয়ে আনতে একযোগে কাজ করব- এই প্রশ্নই সামনে সমাসীন!