এ পর্যন্ত চারটি ঘূর্ণিঝড়। চারটিই তীব্র বা তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী।
রাষ্ট্রপুঞ্জের আইপিসিসি রিপোর্টে বারবার বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা কমতে পারে, কিন্তু তীব্রতা বাড়বে। গত চার বছরের পরিসংখ্যানের পরতে পরতে যেন তারই প্রমাণ। ২২টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে। ১৭টিই তীব্র। এখনও পর্যন্ত চলতি বছরের হিসেব, চারে চার।মরসুম শুরু হয়েছিল উম্পুনের হাত ধরে। ১৯৯৯ সালের পর বঙ্গোপসাগরের প্রথম সুপার সাইক্লোন। সুন্দরবনে আছড়ে পড়েছিল অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় হিসেবে। ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার গতিবেগের ঝড়ের ক্ষত এখনও দগদগে দুই বাংলার ব-দ্বীপে।
এর দু’সপ্তাহের মধ্যেই মহারাষ্ট্রে আছড়ে পড়ে নিসর্গ। ১৯৯৮ সালের পর এই প্রথম কোনও তীব্র ঘূর্ণিঝড় দেশের পশ্চিম উপকূল হয়ে স্থলভাগে ঢোকে। বর্ষার পর বঙ্গোপসাগরে দু’টি গভীর নিম্নচাপ হাজির হয়েছে, যার একটি বাংলায় মেঘলা সপ্তমীর কারণ। অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় না হলেও, দু’দিনের ফারাকে নভেম্বরে জোড়া ঘূর্ণিঝড়। অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় গতি আছড়ে পড়েছে সোমালিয়া উপকূলে। আফ্রিকার দেশটির ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড়। দু’দিনে বৃষ্টি হয়েছে দু’বছরের!
এ বার নিভার। অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় রূপে বুধবার গভীর রাতে আছড়ে পড়েছে পুদুচেরি-তামিলনাড়ু উপকূলে। এমনিতেই ফিরতি বর্ষার বৃষ্টি হচ্ছে দক্ষিণ ভারতে, তার মধ্যে জোরালো ঘূর্ণিঝড়। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা। করোনা-বিধি শিকেয় উঠে আশঙ্কা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ারও।
আবহবিদদের নজরবন্দি আরও একটি বিষয়। দুই সাগরেই ঘূর্ণিঝড় শক্তি বাড়াচ্ছে হুড়মুড়িয়ে। মাত্র ১৮ ঘণ্টার মধ্যে মামুলি ঘূর্ণিঝড় থেকে সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছিল উম্পুন। ২২ নভেম্বর ১২ ঘণ্টারও কম সময়ে অতি গভীর নিম্নচাপ থেকে অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় গতি। শুধু চলতি বছর নয়, হাল আমলে বারবার এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০১৭ সালে আরব সাগরের ঘূর্ণিঝড় অক্ষি ভারত ও শ্রীলঙ্কা মিলিয়ে ৮৪৪ জনের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। মাত্র ৩৩ ঘণ্টার মধ্যে গভীর নিম্নচাপ থেকে চার দফায় শক্তি বাড়িয়ে অতি তীব্র হয়ে ওঠে ঘূর্ণিঝড়। তারও আগে ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চার দফায় শক্তি বাড়ায়। এত দ্রুত সাধারণ মানের ঝড় থেকে প্রবল প্রতাপশালী হয়ে ওঠায় তৈরি হওয়ারই সময় পায়নি মায়ানমার প্রশাসন। মৃত্যু হয় এক লক্ষ ৩০ হাজারের। নিভারও তীব্র থেকে অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে ঘনীভূত হয়েছে চোখের পলকে।
ঘূর্ণিঝড়ের এমন তেজি রূপের নেপথ্যে কারণ কী?
মৌসম ভবনের ডিরেক্টর জেনারেল মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্রের ব্যাখ্যা, ‘তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা একেবারে নতুন তা নয়, তবে ইদানীংকালে শক্তি বাড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আরব সাগরে। এর অনেকগুলি কারণ রয়েছে। সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ নিভারের শক্তিশালী হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে মৌসম ভবনের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘একেবারে শেষ মুহূর্তে সমুদ্রে আরও বেশি সময় থাকার সুযোগ পেয়েছে ঘূর্ণিঝড়টি। ফলে অনেকটাই শক্তি বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। সমুদ্রের উষ্ণ জলতল (২৯-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), বেশি কোরিওলিস ফোর্সের মতো শর্তগুলিও শক্তি বাড়াতে সাহায্য করেছে।’ পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথু কলের মতে, ‘অনেকগুলি বিষয় একসঙ্গে কাজ করেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে লা নিনা পরিস্থিতি চলছে। এর ফলে বায়ুপ্রবাহ আমাদের সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পক্ষে সহায়ক। ম্যাডেন জুলিয়ান অসিলেশনের মতো পশ্চিম থেকে পুবের দিকে মেঘ বয়ে নিয়ে যাওয়া সিস্টেমের অবস্থানও অনুকূল। তৃতীয়ত, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে সমুদ্রের জলতল বেশি মাত্রায় উষ্ণ থাকছে। ঘূর্ণিঝড় যেহেতু সমুদ্রের জল থেকেই জ্বালানি পায়, তাই ইদানীংকালে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির এটিও অন্যতম কারণ।’