নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ২০০৩ সালের দিকে নুহাশপল্লীতে ঔষধি উদ্যান তৈরির কাজ শুরু করেন। মাত্র ২-৩ বছরের মধ্যেই তাঁর এই উদ্যানের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিনই নতুন নতুন চারা জোগাড় করে মহাসমারোহে লাগানো হচ্ছিল সেগুলো। তখন ঔষধি বাগান ঘিরে নুহাশপল্লীতে বিরাজ করছিল চমৎকার উৎসবের আমেজ। বিচিত্র এসব উদ্ভিদের টানেই ২০০৫ সালের একদিন হাজির হলাম সেখানে। জনপ্রিয় কার্টুন ম্যাগাজিন উন্মাদ–এর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে বেশ দ্রুততার সঙ্গেই নুহাশপল্লীতে যোগাযোগ সম্ভব হলো, অনুমতি মিলল বাগান দেখার। পুরো কৃতিত্বই উন্মাদ সম্পাদক কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের।
ভাদ্র মাসের জল–কাদা ডিঙিয়ে নুহাশপল্লী পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে এল। প্রধান ফটক পেরিয়ে ডান পাশেই সুইমিংপুল লাগোয়া ঘর। বাঁ পাশে সুপরিসর সবুজ ঘাসের মাঠ। বিক্ষিপ্ত গাছপালা। বর্ষার কিছু মৌসুমি ফুলের রেশ তখনো বাগানকে আলোকিত করে রেখেছে। আরেকটু এগিয়ে গেলেই ‘বৃষ্টিবিলাস’। সেখানে শুটিংয়ের সেট ফেলা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ শুটিং নিয়ে ব্যস্ত। আমরা তাঁর জন্য অপেক্ষা না করে বাগানে ঢুকে পড়লাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে জানানো হলো, আমরা তাঁর প্রিয় ঔষধি বাগানটি দেখতে এসেছি। তিনি এক ঘণ্টার জন্য শুটিং বন্ধ রেখে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম ঔষধি গাছের এই বাগান তিনি কতটা ভালোবাসেন! ঘুরে ঘুরে বাগানের সব কটি গাছ দেখালেন। কোন গাছটি কীভাবে কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন, কোন গাছে কী উপকার, আবার এই বাগানের উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী—কোনো তথ্যই আমাদের জানাতে বাকি রাখলেন না। আমাকে একটা গাছ দেখিয়ে বললেন এর নাম আইগা তিতা (সম্ভবত আঞ্চলিক নাম)। এই গাছের রস নাকি প্রচণ্ড তিতা এবং অনেক রোগের মহৌষধ। বাগানের দক্ষিণ–পূর্ব পাশে ঢালুতে লাগানো হয়েছে বন এলাচি। এলাচি ঝোপের পাশে আছে যষ্টিমধুর লতা।
নুহাশপল্লীর ৪০ বিঘা জায়গার একাংশে ঢালু জায়গায় গড়ে ওঠা এই বাগানের সংগ্রহ একেবারে কম না। দমকলস, হাতিশুঁড়, বিষকাটালি, অগ্নিশ্বর, ভেরেন্ডা, চিকরাশি, পান, শিয়ালমুর্তা, জয়ত্রী, আপাং, চালধোয়া, শ্বেতচন্দন, কল্পনাদ, কন্টিকারী, রক্তজবা, ওলটকম্বল, ধুতুরা, বাসক, কর্পূর, আগর, রিঠা, পানবিলাস, নিশিন্দা, সর্পগন্ধা, অর্জুন, পুদিনা, তুলসী, আমলকী, নয়নতারা, রক্তকরবী, যজ্ঞ-ডুমুর, গন্ধভাদালী, টগর, জয়তুন, বেত, মালতীলতা, মহুয়া, মেহেদি, কুমারীলতা, বহেড়া, হরীতকী, দাদমর্দন, গিলা, গুলঞ্চ, ঝুমকোলতা, জয়ন্তী, তেলমাখনা, কলকে, সন্ধ্যামলতী ইত্যাদি। এখানে অন্যান্য গাছের তালিকাও বেশ সমৃদ্ধ। লেখক সব সময় চেষ্টা করেছেন কিছুটা অচেনা এবং দুর্লভ গাছ সংগ্রহ করতে। বাগানের বাওবাব গাছটি দেখেই আতোয়া সাঁ এক্সুপেরির লিটল প্রিন্সের কথা মনে পড়ল।
এরপর তিনি মধুমালতীর ফুল দেখাতে নিয়ে গেলেন। তাঁকে জানালাম এ গাছের প্রকৃত নাম রেঙ্গুন ক্রিপার। রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন মধুমালতী। কোথাও কোথাও মধুমঞ্জরি নামেও পরিচিত। বিচিত্র সংগ্রহের অনিন্দ্য এই উদ্যানকে কীভাবে মূল্যায়ন করতেন হুমায়ূন আহমেদ? তাঁর লেখা থেকেই উদ্ধৃত করা যাক, ‘ধরুন কোনো এক অজপাড়াগাঁ—হাতের কাছে নেই ডাক্তার বা হাসপাতাল। প্রসববেদনায় অস্থির কোনো নারী। অবস্থা সংকটাপন্ন। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমন একটা মুহূর্তে নিজ বাড়িতেই ডেলিভারি সম্ভব। যদি রোগীকে সেবন করানো হয় একটি বিশেষ জংলি লতাগাছের কাণ্ড—ছেঁচে একটুখানি রস। এ যেন জীবন্ত ক্লিনিক।’
বাগান ঘুরে দেখানো শেষে আমাকে তাঁর চেনা কয়েকটি গাছের নাম জিজ্ঞেস করলেন। নামগুলো বললাম। তারপর মজা করে বললেন, দশে দশ পেয়েছ। বাগানে লাগানো কারিপাতার দুটি গাছ নিয়ে নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক বুলবুলকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখা গেল। তাকে আশ্বস্ত করলাম দুটিই কারিপাতার গাছ। নুহাশপল্লীর ঔষধি বাগান নিয়ে তাঁর সঙ্গে এটাই ছিল আমার একমাত্র আলাপচারিতা।
এরপর বিভিন্ন প্রয়োজনে একাধিকবার গিয়েছি সেখানে। ২০১৩ সালে ‘তরুপল্লব’ সেখানে গাছ দেখা গাছ চেনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। নুহাশপল্লীর অনেক পরিবর্তন দেখেছি। তাঁর লাগানো গাছগুলো কৈশোর পেরিয়ে রীতিমতো যৌবনে পা দিয়েছে। বিস্তীর্ণ মাঠের লিচু আর খেজুরগাছগুলো ফলবতী হয়েছে। বিশাল পরিসর নিয়ে বেড়ে উঠছে ধূপগাছটি। দর্শনার্থীরা থমকে দাঁড়িয়ে মাঠপাড়ের এক টুকরো চা-বাগানের সৌন্দর্য অবলোকন করছে। পুকুরপাড়ের হাড়গজা আর দেওদারগুলো দেখার জন্য প্রতিদিন অনেকেই ভিড় করছে। কেউ কেউ সোনালি বাঁশ, ডুমুর, দারুচিনি, ম্যাগনোলিয়া বা অলস্পাইস গাছের পাশে দাঁড়িয়ে দিনমান ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকে। বাগানজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে তাঁর এমন আরও অজস্র স্মৃতিবৃক্ষ। এসব বিচিত্র উদ্ভিদের সমাবেশ একজন বৃক্ষপ্রেমী হুমায়ূন আহমেদের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
নুহাশপল্লীর আরেকটি দিনের কথা কখনোই ভুলব না।
২০১২ সালের জুলাই মাস। তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাজির হলাম সেখানে। প্রকৃতিতে তাঁর প্রিয় ঋতু বর্ষাকাল। মাত্র কয়েক দিন আগে কদম ফুটেছে। চারপাশে বিরাট এক শূন্যতা। সেদিন এই বাড়িটি যেন আক্ষরিক অর্থেই কাঁদছিল। তাঁর সন্তানতুল্য বৃক্ষগুলোও যেন বুঝতে পেরেছিল ওদের প্রিয় মানুষটি আর ফিরে আসবে না। আর কখনো গায়ে হাত বুলিয়ে দেবে না, ডাল ছুঁয়ে একটু আদর করে দেবে না। না আর কখনো না…।