বাংলাদেশের নারী জাগরণের মুখপত্র ও উপমহাদেশে নারী বিষয়ক প্রথম সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন নূরজাহান বেগম। দেশের নারী সাংবাদিকতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন প্রবাদতুল্য এ নারী সাংবাদিক। সাংবাদিক সমাজে সাংবাদিকতাসহ নারী জাগরণে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে তার সাহসী পদক্ষেপসমূহ । শুধু বাংলাদেশেরই নয়, নূরজাহান বেগম সারা বিশ্বের একজন শীর্ষস্থানীয় নারী পথিকৃৎ ছিলেন। দেশের নারী ক্ষমতায়ন আন্দোলনে ও নারী পুর্নজাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। শুধু নিজেই একজন আলোকিত নারী ছিলেন না নূরজাহান বেগম। তিনি আলো জ্বালিয়েছেন অন্য নারীদের মাঝেও। তিনি তার পত্রিকার মাধ্যমে এই কাজটি করে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত । সমগ্র সমাজের ভেতরে নূরজাহান বেগম যে চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন; তাঁর গুরুত্ব কতটুকু-তা আজকের নতুন প্রজন্ম হয়ত উপলব্ধি করতে পারবে না।
নূরজাহান বেগম শুধু বেগম পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এটিই তার বড় পরিচয় নয়। নারী মুক্তির অগ্রদূত ছিলেন তিনি। শুধু সামাজিক ও অর্থনৈতিক নয় এটি চিন্তার মুক্তিও ছিল বটে। নারী মুক্তি ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কাজ করেছেন অবিচল ভাবে। সমাজে যখন অবরোধবাসিনীর অবস্থা ছিল তিনি তখন এই বেগম পত্রিকা বের করে নারীদের সচেতন করেছেন, জাগিয়ে তুলেছেন। আত্মবিকাশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন মেয়েদের। বর্ণাঢ্য জীবনী : দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন নূরজাহান বেগম। নারী জাগরণে, নারী অধিকার আদায়ে নূরজাহান বেগম তাই একটি বিশিষ্ট নাম। তার মৃত্যুতে সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারায় বাংলাদেশ। বেগম নিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ হতো। মুসলমান পুরুষরাই যেখানে হিমশিম খাচ্ছিলেন সাহিত্য সংস্কৃতি এবং শিল্পচর্চায়। সেখানে নূরজাহান বেগমের অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক সচেতনতা, শিল্পবোধ এবং নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে বেগমকে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে এতটুকু পিছপা হননি। বেগম পত্রিকায় মূল বিষয়গুলোতে স্থান পায় নারী জাগরণ, কুসংস্কার বিলোপ, গ্রামে-গঞ্জের নির্যাতিত নারীদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠি এবং মনীষীদের জ্ঞানগর্ভ বাণী। সওগাত পত্রিকা অফিসে বসে নূরজাহান বেগম ‘বেগম’ পত্রিকার কাজ করতেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এই বেগমই ছিল তার সব।
নূরজাহান বেগম ১৯২৫ সালের ৪ই জুন চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে পশ্চিমবঙ্গের ভাগলপুরে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা নেন তিনি। সাহিত্য চর্চায় মেয়েদের জায়গা করে দিতে তার বাবা সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন ১৯৪৭ সালে ‘বেগম’ পত্রিকা চালু করেন। প্রথমে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে পত্রিকাটি ঢাকায় চলে আসে। প্রতিষ্ঠার প্রথম চার মাস পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। এর পর সম্পাদনার দায়িত্বে আসেন নূরজাহান বেগম। বাংলাদেশের নারী সাহিত্যিকদের অনেকের লেখার হাতেখড়ি বেগম পত্রিকার মাধ্যমে। নারীদের লেখালেখিতে উৎসাহিত করা নূরজাহান বেগম বলে গেছেন- বেগমের বাইরে আমি কোনোদিনই কোনো কিছু করার চেষ্টা করিনি। বেগমই তো আমার সারা জীবনের কাজ। নারী শিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে রোকেয়া পদকে ভূষিত হন নূরজাহান বেগম। ১৯৫২ সালে কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খানের (দাদাভাই) সঙ্গে বিয়ে হয় নূরজাহান বেগমের। ১৯৯৯ সালে মারা যান দাদা ভাই। ২০১৬ সালে ৯১ বছর বয়সে মারা যান নূরজাহান বেগম। তাঁর চলে যাওয়ার মাধ্যমে ইতিহাসের বিশেষ এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।
(সংগৃহীত ও সম্পাদিত)