নারিকেলবাড়িয়া শব্দটি বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। নাম শুনলেই মনে পড়ে এই গ্রামে বাশেঁর কেল্লা তৈরি করেছিলেন মীর নিসার আলী (তিতুমীর)। তবে এই নারিকেলবাড়িয়া সেই বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও চিরায়ত বাংলার প্রকৃত রূপ দেখা যায় এ গ্রামে। প্রচুর নারিকেল গাছের মধ্যে বাড়িঘর থাকায় নামকরণ করা হয় ‘নারিকেলবাড়িয়া’।
ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি জনপদের নাম নারিকেলবাড়িয়া। এই নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে নারিকেল গাছের পাশাপাশি খেজুর গাছও রয়েছে অনেক। গ্রাম বাংলার মেঠো পথ দিয়ে হাঁটার সময় দেখা যায় দুপাশে সারিবদ্ধ খেজুর গাছ। পরিকল্পিতভাবে খেজুর চারা রোপণ করা না হলেও প্রাকৃতিকভাবেই কোনো পরিচর্যা ছাড়াই গাছগুলোর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।
ঝালকাঠিতে শীতের শুরুতেই খেজুরের মিষ্টি রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা। শীতের তীব্রতা শুরু না হলেও পুরোদমে আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। তবে ইটভাটায় খেজুর গাছ ব্যবহার এবং নতুন করে রোপণ না করায় দিন দিন ঝালকাঠিতে হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুর গাছের পরিমাণ।
জেলার রাজাপুর কাঁঠালিয়া খেজুর রস ও গুড়ের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল। তবে সময় পরিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই দিন। কয়েক বছর আগেও উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতে, খেতের আইলের পাশে কিংবা রাস্তার দুই পাশে অসংখ্য খেজুর গাছ ছিল। কোনো পরিচর্যা ছাড়াই অনেকটা প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠে এইসব খেজুর গাছগুলো।
প্রতিটি পরিবারের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত রস দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু গুড়। অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় এলাকার চাহিদা পূরণ করে বাড়তি গুড় সরবরাহ করা হতো দেশের বিভিন্ন স্থানে। বর্তমানে বসতবাড়ি কিংবা খেত-খামারের পাশে এমনকি রাস্তাঘাটের পাশে আর আগের মতো খেজুর গাছের দেখা মেলে না।
একসময় শীত মৌসুমে খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন অনেকে। স্থানীয় ভাষায় এ মৌসুমি পেশাজীবীকে বলা হয় শিয়ালী। শেয়ালের সঙ্গে খেজুরের রসের নানা লোককথা বা গল্প থেকে গাছিদের স্থানীয় ভাষায় নামকরণ হয় শিয়ালী। বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ গাছিরা তাদের পূর্ব পুরুষদের পেশা ছেড়েছেন। তবে হাতেগোনা কয়েকজন এখনো ধরে রেখেছেন পেশা।
জেলার কচুয়া গ্রামের গাছি হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বাঙালিরা মৌসুমভিত্তিক কিছু খাবারের প্রতি আকৃষ্ট। খেজুর গাছের রসের প্রতি আমাদের দুর্বলতা এখনো আছে। আমার বাবার পেশা ছিল এই খেঁজুর গাছের রস সংগ্রহ করা। বাবার মারা যাওয়ার পর তিনি পেশাটি ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় পেশাটি বর্তমানে ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছি না।’
দক্ষিণ চেচঁরী গ্রামের গাছি কামাল হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘আমরা খেজুর গাছের কথা ভুলে গেছি। আমাদের উচিত অন্যান্য বৃক্ষ রোপণের পাশাপাশি খেজুর গাছ রোপণ করা। নতুবা আগামী প্রজন্মের কাছে খেঁজুর গাছ অচেনা গাছে পরিণত হবে।’
রাজাপুরের নারিকেল বাড়িয়া গ্রামের কয়েকজন গাছি জানান, শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে গাছ পরিষ্কার করতে হয়। এরপর গাছ কেটে মিষ্টি রস সংগ্রহ করা হয়। এখন তারা গাছ পরিষ্কার ও কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
কাঁঠালিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বর্তমানে বসতবাড়ি কিংবা খেত-খামারের পাশে এমনকি রাস্তাঘাটের পাশে আর আগের মতো খেজুর গাছের দেখা মেলে না। আমাদের অসচেতনতার কারণে আজ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে পরিবেশবান্ধব গুরুত্বপূর্ণ এই খেজুর গাছ। খেজুর গাছের এই সংকট নিরসনে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং বেশি বেশি করে সাধ্যমতো খেজুর গাছ রোপণ করতে হবে।’ এ বিষয়ে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
খেজুর গাছের এ সংকট সত্ত্বেও ঝালকাঠি জেলায় এখনো যেসব গাছ অবশিষ্ট আছে তা কেটে রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। সকালের মিষ্টি রোদে রসের আয়োজন আর কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে এখনই। তবে আরও কিছুদিন পর শীতের এ রস উৎসব শুরু হবে পুরোদমে।