বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে হঠাৎ অস্থির দেশ। কারা এই অস্থিরতা সৃষ্টি করছে? নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। বেড়েছে জঙ্গিদের আনাগোনাও। জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় সারাদেশের সকল ইউনিটকে পুলিশ সদর দফতরের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে আবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাংচুর এবং ভাস্কর্যের পক্ষের মানুষের প্রতিবাদ বিক্ষোভে উত্তাল সারাদেশ। ভাস্কর্যের পক্ষে রাস্তায় নেমেছে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যেকোনও মূল্যে এই অস্থিরতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা হবে।
বলা যায় হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলামসহ কিছু ইসলামি দলের নেতারা বক্তব্য দেন। গত ১৩ নভেম্বর রাজধানীর ধোলাইখালে এক সমাবেশে চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের নেতারাও একই ধরনের বক্তব্য রাখেন। কেউ কেউ ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন। হেফাজতে ইসলামের নতুন আমীর মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে এক সমাবেশে হুমকি দিয়ে বলেন, ভাস্কর্য তৈরি হলে তা টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেওয়া হবে। প্রতিবাদে পাল্টা বক্তব্য দিতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন দল, ব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। সরকারের মন্ত্রীরাও প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই গত ১১ ডিসেম্বর রাতে কুস্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষক।
অন্যদিকে, সারাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা হুট করেই বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে। রাজধানী ছাড়াও নোয়াখালী ও সিলেটে এমসি কলেজে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আলোচনায় আসে। সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ধর্ষণ কমেনি। এ বছরের (২০২০) জানুয়ারি থেকে নভেম্বর (২০২০) পর্যন্ত নয় মাসে এক হাজার ৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থা নারীর প্রতি সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এরইমধ্যে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটসহ পুলিশের সকল সংস্থা জঙ্গিদের গ্রেফতারে জোর তৎপরতা শুরু করেছে। পুলিশ সদর দফতরের পক্ষ থেকে গত ১৯ জুলাই জঙ্গি হামলা মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থান নিতে সারা দেশের সকল ইউনিট প্রধানদের চিঠি পাঠানো হয়।
প্রশ্ন উঠেছে, দীর্ঘদিন দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করলেও হঠাৎ কারা দেশকে অস্থির করে তুলতে চাইছে? ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য দেওয়াসহ নানা ইস্যু তৈরির চেষ্টা চলছেই বা কেন? নেপথ্যে কারা? জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘হঠাৎ নয়, ষড়যন্ত্রকারীরা এটা সবসময়ই করছে। কখনও একটু চুপচাপ থাকে। কখনও জোরদার করে। জঙ্গিতো এমনি এমনি আসেনি। আমাদের এখান থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে। উস্কানি দেওয়া হয়েছে। আমরা যখন এগুলো কন্ট্রোল করেছি, তখন ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এসব যারা করেছে তাদেরকে চিহ্নিতও করেছি।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ যখন উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, একটা স্থিতিশীল পরিবেশ যখন তৈরি হয়েছে, তখনই এ সমস্ত ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আগের ঘটনাগুলোর সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল তারাই এসব ঘটাচ্ছে। যারা বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতি পছন্দ করে না, শুরু থেকেই বাংলাদেশকে যারা ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র বানাচ্ছিল তারাই করছে। আমি বলব যারা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু কন্যাকে যারা হৃদয়ে স্থান দিতে পারেনি কিংবা তার অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত হচ্ছে, তারাই ইস্যুগুলো তৈরি করছে, দেশকে অস্থির করছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা দেখেছি যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত করছে ওরা শিশুতুল্য। বুদ্ধি বিবেক এখনও সমৃদ্ধ হয়নি। ওরা এখনও ওস্তাদের কথায় চলে। তাদেরকে যে লালন করে তাদের কথা শুনে। মাদ্রাসার যে ছাত্ররা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা সত্যিকার বিষয়টি জানে না। সেদিন আমি ফেসবুকে দেখছিলাম, মাদ্রাসার এক ছাত্র বলছে তার আদর্শিক গুরু মামুনুল হক। সেই আদর্শিক গুরুর শিস্যরা অজ্ঞ। এখনও শিক্ষার আলো তাদের জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করেনি। তারা বলছে স্বাধীনতা যুদ্ধে এমন আর কত রক্ত ঝরেছে! তার চেয়ে বেশি রক্ত ৫ মে হেফাজতের আন্দোলনে ঝরেছে! আমরা চ্যালেঞ্জ করে বলছিলাম যে হেফাজতের আন্দোলনে কে কে মারা গেছে নাম পাঠান। একটা নামও তারা পাঠায়নি। অথচ এখনও তাদের এগুলো শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তারাই তৈরি থাকে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য। ডাক দিলেই চলে আসে। এদের কারা ডাক দেয়? সেই জামায়াতে ইসলামির লোকেরাই দেয়। বিএনপি দেয়। দেশকে অস্থির করার পেছনে তারাই জড়িত।
সর্বশেষ সোমবার (১৪ ডিসেম্বর) রাতে ধানমণ্ডির বাসভবনে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের বেফাকের চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদসহ আলেমদের ১২ জন প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়ে ভাস্কর্যের পরিবর্তে মুজিব মিনারসহ পাঁচটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। যেগুলো আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যাবে বলে মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অন্যদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা ও চুরি ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়া নিয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলব সেরকম বাড়েনি। কোভিড পরিস্থিতিতে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ে গেছে। মানুষ চাকরি হারাচ্ছে, ব্যবসা হারাচ্ছে। সেই হিসেবে বলতে পারি আমরা অনেক ভালো আছি। এর চেয়ে আরও বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে সারা বিশ্ব। দু’একটা ছিনতাই, চুরি হচ্ছে না, সেটা অস্বীকার করব না। কিন্তু আমরা মনে করি যে এখনও বড় আশঙ্কার জায়গায় আমরা যাইনি। যা হচ্ছে সেটা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।