এটি একটি বিধ্বংসী বছর। কোভিড–১৯ মহামারিতে ১৬ লাখের বেশি মানুষ এরই মধ্যে মারা গেছেন। সেই সঙ্গে সাড়ে ৭ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং অর্থনৈতিক খাতে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ১০০ কোটির বেশি শিশু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্কুলে যেতে পারেনি। এ বছর যুক্তরাষ্ট্র জর্জ ফ্লয়েড ও ব্রেওনা টেলরের হত্যা দেখেছে, দেখেছে বিধ্বংসী দাবানল এবং এমন একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, যা আধুনিক সময়ে আর দেখা যায়নি।
চলতি বছরের বেশির ভাগ সময়টা আমি ফাউন্ডেশনের সহকর্মীদের সঙ্গে কাটিয়েছি এবং এর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে কোভিড–১৯ প্রতিরোধ, চিকিৎসা এবং এর শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালানোর পথ খোঁজা। ২০২০ সালের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রার গতি নিয়ে আমি যখন ভাবি, তখন স্তম্ভিত হয়ে যাই। এ বছর কোভিড–১৯–এর কারণে বিশ্বে যে পরিমাণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হয়েছে, অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে এক বছরে মানুষ এতটা এগোতে পারেনি। সাধারণ সময়ে, একটি টিকা তৈরি করতে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এবার এক বছরের কম সময়ে একাধিক টিকা তৈরি করা হয়ে গেছে।
দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এখনো প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারিনি। কম্পিউটারে তৈরি মডেলে দেখা গেছে, সামনের মাসগুলোতে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন (স্ট্রেইন) আবির্ভূত হয়েছে এবং সে বিষয়েও আমাদের জানতে হবে। করোনাভাইরাসের এই নতুন ধরন আরও দ্রুত ছড়াচ্ছে, যদিও এটি ততটা প্রাণঘাতী নয় বলে মনে হচ্ছে।
তবু আশাবাদী হওয়ার জন্য দুটি কারণ হাজির আছে। একটি হলো মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মধ্য দিয়ে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতি কমিয়ে দেওয়া এবং এর মাধ্যমে টিকা সর্বত্র পৌঁছানোর আগপর্যন্ত জীবন বাঁচানো।
আশাবাদী হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, ২০২১ সালের বসন্তে করোনার টিকা ও চিকিৎসা –ম্পর্কিত যেসব খবর আপনারা এখন সংবাদমাধ্যমে পড়ছেন, সেগুলো এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে এর বৈশ্বিক প্রভাব জোরদার হতে থাকবে। যদিও তখনো কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলার প্রয়োজন হবে (উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বড় জনসমাগমের কথা), তবে অন্তত ধনী দেশগুলোতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমে আসতে থাকবে এবং এখনকার তুলনায় জীবন অনেক স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এই পোস্টে আমি কোভিড–১৯ বিষয়ক সব ধরনের উদ্ভাবনগুলো সম্পর্কে নানা বিষয় ভাগাভাগি করতে চাই। কারণ, আমরা এ বছর শেষ করে নতুনটির দিকে এগোচ্ছি। আমি টিকা দিয়েই শুরু করছি; কারণ, টিকার বিষয়টি খবরে আসছে বারবার এবং এই বিষয়েই আমি বেশি প্রশ্ন পেয়েছি।
কোভিড–১৯ টিকা কীভাবে কাজ করবে
আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে মডার্না ও ফাইজার–বায়োএনটেকের তৈরি দুটি টিকা যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেয়ে গেছে। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশেও অনুমোদন পেয়েছে। আরও কিছু কোম্পানি তাদের টিকার কার্যকারিতার পরীক্ষার ফল হয়তো শিগগিরই ঘোষণা করবে।
আপনি যে বিষয়টি সম্পর্কে পড়েননি, তা হলো প্রথম দুটি টিকার সফলতা অন্যান্য কোম্পানির জন্যও ভবিষ্যতে সফল হওয়ার আশাবাদ দেখাচ্ছে। কার্যত সব টিকাই এখন কার্যকারিতাবিষয়ক পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে, যেটি ওই দুটি টিকা পার হয়ে এসেছে। এখন এই গবেষকেরা জানেন যে করোনাভাইরাসের প্রোটিন অংশটিকে আঘাত করলে তা কাজে দিতে পারে। সুতরাং অন্যান্য টিকার ক্ষেত্রে, যারা একই পন্থায় এগোচ্ছে, তাদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এই মৌলিক মিলের বিষয়টি বাদ দিলে বিভিন্ন টিকা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ভাইরাসকে আক্রমণ করার উপায় নিচ্ছে। মডার্না ও ফাইজার–বায়োএনটেক এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। এই পদ্ধতির সঙ্গে আমাদের ফাউন্ডেশন বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। কারণ, ২০১৪ সাল থেকে এই পদ্ধতিতে ম্যালেরিয়া ও এইচআইভির টিকা তৈরির গবেষণায় আমরা অর্থায়ন করে আসছি। এটি অসাধারণ বিষয় যে কোভিড–১৯ বিষয়ে অতুলনীয় অগ্রগতি অর্জনে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।
এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিরাচরিত পদ্ধতির তুলনায় অনেক দ্রুত এ ধরনের টিকা তৈরি করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এমআরএনএ পণ্য তৈরি করার মতো যথেষ্ট কারখানা নেই। কিছু টিকা আবার মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। ফলে এসব টিকা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিতরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে। যদিও এটি যত না বৈজ্ঞানিক প্রতিবন্ধকতা, তার চেয়ে বেশি হলো প্রকৌশলগত প্রতিবন্ধকতা।
অন্যদিকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভিন্ন ধরনের একটি টিকা তৈরি করেছে। এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহারের বদলে এটি শিম্পাঞ্জির মধ্যে দেখা দেওয়া সাধারণ ঠান্ডা–জ্বরের স্পাইক প্রোটিন যুক্ত করা হয়েছে, যা কিনা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। এতে আপনার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বুঝতে পারে যে স্পাইককে আক্রমণ করতে হবে এবং এ থেকেই আপনি কোভিড–১৯ থেকে সুরক্ষা পেয়ে যাবেন। কার্যকারিতার পরীক্ষায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা প্রায় ৭০ শতাংশ কার্যকর বলে দেখা গেছে। ফাইজার ও মডার্নার টিকার কার্যকারিতা সে ক্ষেত্রে ৯৪ থেকে ৯৫ শতাংশ। কিন্তু রোগ থামানোর জন্য ৭০ শতাংশ কার্যকারিতাও বেশ উচ্চ হার। এ কারণে একই পদ্ধতিতে তৈরি হতে যাওয়া জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা নিয়েও আশাবাদী হওয়ার ক্ষেত্র রয়েছে।
টিকা নিয়ে কাজ করা একাধিক কোম্পানির কাজের হালনাগাদ তথ্য জানতে গিয়ে আপনি যদি হিমশিম খান, তবে আপনাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এটি একটি মধুর সমস্যা! অনেক কোম্পানি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে টিকা তৈরির কাজ করায় এটি বলা যায় যে কিছু নিশ্চয়ই নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হবে। এমন দুটি টিকা এরই মধ্যে পাওয়া গেছে এবং আরও আসছে।