২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ‘ঘ’ আর চারুকলা অনুষদভুক্ত ‘চ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে বরং বিজ্ঞান (ক), কলা (খ) এবং ব্যবসা শিক্ষা (গ)—এই তিন ইউনিটে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে বিষয় ভিত্তিক দক্ষতা যাচাইসহ শিক্ষার্থী যাচাই-বাছাইয়ে কিছু জটিলতা তৈরি হবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ৷ আবার বিজ্ঞান বা ব্যবসা শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে যদি নিজ বিভাগে না থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে নিজ বিভাগভিত্তিক পরীক্ষা দিয়েই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য বিভাগে যেতে হবে৷ এছাড়াও কোনও শিক্ষার্থী নিজ বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও অন্য বিভাগের সাবজেক্ট নিয়ে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে৷ এসব জটিলতাসহ আরও কিছু জটিলতার কথা জানা গেছে৷
এসব জটিলতা থাকলেও মূলত, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে তিন ধরনের শিক্ষা ধারা রয়েছে যেমন, বিজ্ঞান, মানবিক এবং ব্যবসা শিক্ষা। এ তিন ধারার আলোকেই শুধু তিন ইউনিটে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে এই তিনটি ধারার পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে মিল রেখেই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করা হবে। এর ফলে পাঠ্যপুস্তকমুখী চর্চাটাও গড়ে উঠবে। শুধু তাই নয়, পরীক্ষার সংখ্যা কমানো ,শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ভোগান্তির লাঘব করা, গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পার্থক্য দূর করা, কোচিং নির্ভরতা কমানো যাবে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শিক্ষকরা৷
রবিবার (৮নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটির মিটিংয়ে ‘ঘ’ আর ‘চ’ ইউনিট বিলুপ্ত করে মাত্র তিনটি ইউনিটে ভর্তি নেওয়ার কথা জানানো হয়। যা আগামী শিক্ষাবর্ষ (২০২১-২০২২) থেকে কার্যকর হবে৷ শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির সুবিধার্থে এক বছর আগ থেকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়৷ তবে এ বছর আগের নিয়মেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে৷
‘ঘ’ আর ‘চ’ ইউনিট বিলুপ্ত করার বিরোধিতা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চারুকলা (চ ইউনিট) একটি স্পেশালাইজড ইউনিট৷ অনুষদটি কী ধরনের শিক্ষার্থী নেবে সে সম্পর্কে চারুকলার শিক্ষকরাই সবচেয়ে ভালো জানেন৷ তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষার্থীর সুনির্দিষ্ট দক্ষতার ভিত্তিতেই তারা শিক্ষার্থী বাছাই করবেন ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে এবং এ দায়িত্বটাই অনুষদেরই৷
তিনি আরও বলেন, ঘ ইউনিটের ক্ষেত্রে মূল কথা হলো, এটা বিভাগ পরিবর্তনের ইউনিট। এর আওতায় ১২টি বিভাগ রয়েছে৷ যারা বিজ্ঞানে পড়তে চায় না, তাদের কোন প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া হবে বা কোন দক্ষতা যাচাই করা হবে। যখন প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয় তখন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিশেষত্ব বিবেচনায় নিয়ে তা করা হয়৷ এখন বিজ্ঞানে যারা ভর্তি পরীক্ষা দিবে, তখন কিসের ভিত্তিতে তাদের আমরা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি করবো? যারা বিজ্ঞান অনুষদে পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের সবাই সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হতে চায়, বিষয়টা তা নয়। এখন কেউ বিজ্ঞান ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের সাবজেক্টে ভর্তি হবে, এটার ভিত্তিটা কী হবে?
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ (ঘ) ইউনিটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য মূলত বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ রাখা হয়৷ অর্থাৎ কোনও শিক্ষার্থী যদি উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগ থেকে শেষে করে৷ এরপর সে যদি চায় অন্য বিভাগে চলে যাবে, তখন ঘ ইউনিটের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে বিভাগ পরিবর্তন করতো হতো৷ এখন ঘ ইউনিট বিলুপ্ত হলে আগের মতোই বিভাগ পরিবর্তন করতে পারবে৷ কিন্তু পার্থক্যটাই হচ্ছে, আগে উচ্চ মাধ্যমিকের পর বিভাগ পরিবর্তন করে ঘ ইউনিটের পরীক্ষা দিতো আর এখন উচ্চ মাধ্যমিক যে বিভাগ থেকে শেষ করবে সে বিভাগের ওপর ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই বিভাগ পরিবর্তন করা লাগবে৷
এক্ষেত্রে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক তানজীমউদ্দীন খান যে জটিলতা দেখছেন তা নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরে তিনি বলেন, যেমন আমি সায়েন্স থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্সে পড়বো না৷ এজন্য ঘ ইউনিটে পরীক্ষা দিলাম৷ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক রকম যেমন ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি জানা জরুরি আর সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষাগত, পঠনগত এবং প্রশ্ন করতে পারার দক্ষতা চাই। সায়েন্স বা বিজনেস ফ্যাকাল্টি সামাজিক বিজ্ঞানে শিক্ষার্থী নেওয়ার ক্ষেত্রে কীভাবে এগুলো নিশ্চিত করবে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদটির যে ধরনের শিক্ষার্থী দরকার সে ধরনটি বিবেচনা করেই তো প্রশ্ন করা হয়৷ আবার বিজ্ঞানের ছাত্রদের তো সামাজিক বিজ্ঞানের সাবজেক্টে পড়ার দক্ষতা এবং আগ্রহ থাকতে হবে৷ জোর করে তো আর কাউকে সামাজিক বিজ্ঞানে ঠেলে দেওয়া যায়না৷ ইতোমধ্যে এগুলো বিবেচনা করে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি পরীক্ষায় বর্ণনামূলক প্রশ্ন প্রবর্তন করা হয়েছে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
এখন ঘ ইউনিট বিলুপ্ত হয়ে খ ইউনিটের সঙ্গে সমন্বিত হলেও আগের মতোই শিক্ষার্থীরা বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ পাবে৷ সে সুযোগ আগের মতোই রাখা হবে৷ এর জন্য ভিন্ন কলা কৌশল নেওয়া হবে বলে জানা গেছে৷ আর চারুকলা অনুষদ (চ) যেহেতু একটি বিশেষায়িত ইউনিট৷ এর জন্য আলাদা ব্যবহারিক পরীক্ষা রাখা হবে, যা এখনও রয়েছে৷ এছাড়াও নাট্যকলা,নৃত্যকলা এবং সংগীত বিভাগের জন্যও ভিন্ন পদ্ধতি রাখা হবে৷ অর্থাৎ পাঁচটি ইউনিট থেকে কমিয়ে বিষয় ভিত্তিক তিনটি ইউনিটে পরীক্ষা নেওয়া হলেও আগের মতোই সব ব্যবস্থা থাকবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা৷
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. হাসানুজ্জামান বলেন, আগেও উচ্চ মাধ্যমিকের তিনটি গ্রুপের উপর ভিত্তি করে পরীক্ষা নেওয়া হতো৷ এখন শিক্ষার্থীদের স্বার্থে আগের নিয়মেই ফিরে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ৷ দেখা গেছে, খ এবং ঘ ইউনিটের পরীক্ষার প্রশ্নের বাংলা, ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞান থেকে হয়৷ প্রশ্নের ক্যাটাগরি একই৷ সাধারণ জ্ঞান উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তক ভিত্তিক না৷ সেক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হয়৷ গ্রামের শিক্ষার্থীদের তুলনায় শহরের শিক্ষার্থীরা পরিবেশের কারণে সাধারণ জ্ঞান ভালো পারে৷ শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে দুটো পরীক্ষার পরিবর্তে একটি নেওয়ার হবে৷ এতে কোনও সমস্যা হবে না৷ চারুকলা, নাট্যকলা,নৃত্যকলা,সংগীতের মত সাবজেক্টে আলাদা ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়া হবে৷
বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে প্রশ্ন করা হলো তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে তিন ধরনের শিক্ষা ধারা রয়েছে৷ বিজ্ঞান, মানবিক এবং ব্যবসা শিক্ষা৷ এখন যদি তিনটা ধারায় তিনটি ইউনিটে পরীক্ষা নেই আর ওই তিনটি ধারার পাঠ্যপুস্তকের ভিত্তিতে পরীক্ষার প্রশ্ন করি, তাহলে পাঠ্যপুস্তকমুখী চর্চাটাও গড়ে উঠবে৷ পরীক্ষার সংখ্যা, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির সব দিকটিই লাঘব হবে৷ তিন ইউনিটের মাধ্যমেই শিক্ষার্থী বাছাই করা হবে৷ একইসঙ্গে কেউ যদি বিভাগ পরিবর্তন করতে চায়, সে সুযোগও রাখা হবে৷ আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হতো শুধু তিন ইউনিটে৷ আমি নিজেও বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কলা অনুষদের সাবজেক্টে নিয়ে পড়েছি৷ সে ব্যবস্থাও থাকবে৷