করোনাভাইরাস এক অভূতপূর্ব স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এটা এখন সবাই স্বীকার করছেন, এ মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য টিকাই হবে সর্বোত্তম ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশের মতো বিশাল জনসংখ্যার দুর্বল অবকাঠামোর দেশে সবাইকে টিকা দেওয়ার কাজটিও হবে দুরূহ।
টিকা বহন ও সংরক্ষণ করতে হয় নিম্ন তাপমাত্রায় বা শীতলতার মধ্যে। সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ কভিড টিকার জন্য। প্রত্যন্ত এলাকার বিপুল জনসংখ্যার জন্য টিকা বহন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই অনেক দেশেই। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছে ব্রিটেনের গবেষণা সংস্থা ইউকে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন। তাদের এ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম ও হ্যারিয়ট-ওয়াট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক গবেষকরা। এ গবেষণায় আরও আছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষকরা দেখবেন, বাংলাদেশের টিকাদানে কোল্ড চেইন ফ্রেমওয়ার্ক বা শীতল তাপমাত্রায় সরবরাহের সক্ষমতা কতটা রয়েছে। এর ভিত্তিতে বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য টিকা সরবরাহের রোডম্যাপ প্রস্তুত করবেন তারা।
শনিবার বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ওষুধ ও টিকা শিল্প। তবে কভিডের মতো সংকট সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা স্বভাবতই নেই এখানে। বলা বাহুল্য, করোনাভাইরাসের টিকা জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশকেই দিতে হবে, যা অন্য টিকার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। কোনো কোনো দেশ তো এরই মধ্যে জনসংখ্যার সমানসংখ্যক টিকা কেনার চুক্তিও করে ফেলেছে।
বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি এর আগে রুয়ান্ডা ও ভারতের কোল্ড চেইন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেছে। এবার বুয়েট ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়কে সঙ্গে নিয়ে তারা সম্ভাব্য তাপমাত্রা-স্পর্শকাতর কভিড-১৯ টিকা সরবরাহের জন্য নতুন উপায় উদ্ভাবন করবে। এ জন্য এ দেশের বিদ্যমান কোল্ড চেইন সক্ষমতাকে যাচাই করে তারা এ কাজে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানিসাশ্রয়ী সমাধান বের করার চেষ্টা করবে। করোনা টিকা ব্যাপক হারে দেওয়ার পাশাপাশি নতুন ব্যবস্থা ভবিষ্যৎ দুর্যোগেও সহায়ক হবে বলে গবেষকরা আশা করছেন।
বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং এ প্রকল্পের অন্যতম গবেষক টবি পেটার্স বলেন, করোনাভাইরাস বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে দরকার ব্যাপক হারে টিকাদান। তারা নতুন যে পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে যাচ্ছেন, তাতে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই টিকাদান সহজ হবে। টেকসই কোল্ড চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো গেলে তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতিও উপকৃত হবে। তারা বাংলাদেশের জন্য যে রূপরেখা তৈরি করবেন, তার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী কভিড টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে।
এ প্রকল্পে যুক্ত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারজানা মুন্সী বলেন, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে এমন ব্যবস্থা তৈরি করা, যা জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিসরে করোনার টিকা সরবরাহের পাশাপাশি ভবিষ্যতে অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারিতেও সহায়ক হবে। বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, তাদের শিক্ষকরা জ্বালানিসাশ্রয়ী ও গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সেবা দিয়ে আসছেন। এই কাজে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এ প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির বিবৃতিতে বলা হয়, তাদের গবেষণার ফল অন্যান্য দেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে, যাতে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহে টেকসই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা তৈরিতে অন্যরাও একে কাজে লাগাতে পারেন।
ব্রিটেনের বাণিজ্য সচিব অলোক শর্মা বলেন, করোনাভাইরাসকে পরাজিত করা একটি বৈশ্বিক প্রয়াস। তাই তারা এ ধরনের গবেষণায় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। এই গবেষণা প্রকল্পে তাদের সহায়তার ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীও কভিড মোকাবিলায় সক্ষম হবে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ মহামারিতেও এসব জনগোষ্ঠী সুরক্ষা পাবে।
বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ক্লিনিক্যাল প্রভাষক ও এ ধরনের একাধিক গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া ক্রিস্টোফার গ্রিন বলেন, টিকার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য রোগেও বিশ্বের দরিদ্র এলাকাগুলোতে প্রতিবছর বহু লোক প্রাণ হারায়। কভিড টিকা নিরাপদে ও কার্যকরভাবে পৌঁছানোর উপায় উদ্ভাবন করা এখন একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার। সরবরাহের উপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি সম্ভব হলেই কেবল কভিড টিকার পুরো সুফল পাওয়া যাবে। ভবিষ্যতেও এ ব্যবস্থা কাজে দেবে।